পারমাণবিক শক্তির অন্যতম রূপকার

১৯২০ সালের পর্যায় সারণি বলার মতো একটি রূপ পায়। তবুও মেনডেলিভের ফাঁকা রাখা অধিকাংশ মৌলই তখনো অনাবিষ্কৃত। তেজস্ক্রিয়তা ও মেনডেলিভের না-বলা মৌল আবিষ্কারে এগিয়ে আসেন কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞানী। পর্যায় সারণি তাঁদের মাধ্যমে পরিপূর্ণতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যায়।

নোবেলজয়ী এমিলিও সেগ্রেও অগ্রগামী পদার্থবিজ্ঞানীর মাঝে অন্যতম। এই পারমাণবিক পদার্থবিদ ছিলেন কৃত্রিম মৌল আবিষ্কারের অগ্রদূত। যে মৌল পৃথিবীতে পাওয়া যায় না কিন্তু ল্যাবে তৈরি সম্ভব—এটাই কেউ জানতেন না কিংবা ভাবতে পারেননি। 

রোমের কাছের শহর টিভোলিতে ১৯০৫ সালে জন্ম বিজ্ঞানী সেগ্রের।সেখানেই বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেন ইউনিভার্সিটি অব রোম লা স্যাপিয়েনজায়। ডক্টরেট করেছেন তৎকালীন অন্যতম জাঁদরেল পারমানবিক পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির সংস্পর্শে থেকে। পারমানবিক বোমা নিয়ে গবেষণায় ফার্মি একটি তরুণ বিজ্ঞানীদের দল গঠন করেন।

সেগ্রে সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাঁরা ধীরগতির নিউট্রন উৎপাদনে সফল হন। যার মাধ্যমে পারমাণবিক বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করার পথ উন্মুক্ত হয়। 

১৯৩৬ সাল। পালেরমো বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Palermo) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন সেগ্রে।এই সময়টাতে রোমে অর্জিত সকল অভিজ্ঞতার সুব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীরা আগেই ধারণা করেছেন, পর্যায় সারণিতে ম্যাঙ্গানিজের ধর্মের অধীনে ‘অজ্ঞাত’ বা ‘অজানা’ একটি মৌল রয়েছে। তবুও নানান জটিলতায় সেটি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেকে বারবার দাবি করলেও ৪৩তম মৌলটি অধরাই থেকে যায় দীর্ঘ সময়।

সাল ১৯৩৭। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সেগ্রে ও তাঁর সহকর্মী কার্লো পেরিয়ারকে মলিবডেনামের একটি নমুনা পাঠান। কার্লো ছিলেন খনিজ রসায়নবিদ। মলিবডেনামের নমুনাটি সাইক্লোট্রনে ফেলা বোমা থেকে নেওয়া। যা ডিউটেরনের সাথে (বোমাবর্ষণ) নিক্ষেপ করা হয়। বিস্ফোরণে অস্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। সেগ্রে ও কার্লো গবেষণায় টেকনেশিয়ামের সন্ধান পান ল্যাবে; কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত রাসায়নিক উপাদান টেকনেশিয়াম। সেগ্রে প্রমাণটি রেকর্ড বইয়ে তালিকাভুক্ত করে পাঠিয়ে দেন কর্তৃপক্ষের কাছে। টেকনেশিয়ামের অর্ধায়ু ৪০ লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বয়স ৪৫০ কোটি বছর ধরে নিলেও শুরুর দিকে টেকনেশিয়ামের অস্তিত্ব ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই।

সেগ্রের জন্ম ইহুদি পরিবারে। তাই ১৯৩৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গবেষণা সফরে থাকার সময় ফ্যাসিবাদী সরকারের রোষানলে পড়েন। বেনিটো মুসোলিনির সরকার পালেরমোর পদ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করে। যুদ্ধের সময়কালে বার্কলেতে তিনি তার কাজ চালিয়ে যান। এছাড়া অ্যাস্টাটাইনও প্লুটোনিয়াম-২৩৯ আইসোটোপ আবিষ্কারে সহায়তা করেছেন।  ১৯৪৩ সালে মানহাটন প্রজেক্টের একটি দলের দলপতি বা লিডার হয়েছিলেন। ৯ই অগাস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের নাগাসাকিতে প্লুটোনিয়াম-২৩৯-এর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমাটি ছিল মানব ইতিহাসের কলঙ্কময় একটি অস্ত্র। এই বোমা তৈরির কাজে সেগ্রে ছিলেন সামনের সারির অন্যতম একজন।

সেগ্রেকে মার্কিন নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বের্কলেতে শিক্ষকতা করেছেন। কাজ করেছেন সেখানকার পদার্থবিদ ওয়েন চেম্বারলেইনের সাথে। দুনজনের একান্ত প্রচেষ্টায় অ্যান্টিপ্রোটন আবিষ্কার হয়। সেই অবদানের জন্যই ১৯৫৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দুজনে ভাগ করে নেন।

১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫
রোমের কাছের শহর টিভোলিতে জন্ম।

১৯২২
ইউনিভার্সিটি অব রোমে শুরুতে প্রকৌশল ও পরে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা।

১৯২৮
এনরিকো ফার্মির তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন।

১৯২৮
ইতালিয়ান আর্মিতে ছিলেন বছরখানেক।

১৯৩২
ইউনিভার্সিটি অব রোমে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৯৩৬
পালেরমো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত।

১৯৩৭
টেকনেশিয়াম আবিষ্কার।

১৯৩৮
ইতালির ইহুদি-বিরোধী আইনে পদ থেকে বরখাস্ত হন।

১৯৪০
গবেষণায় অ্যাস্টাটিন ও প্লুটোনিয়াম-২৩৯ উদ্ধার।

১৯৪৩-১৯৪৬
লস অ্যালমস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে মানহাটন প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।

১৯৫৯
নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।

১৯৭২
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রোমে প্রত্যাবর্তন।

২২ এপ্রিল ১৯৮৯
হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু।

Related posts

Leave a Comment